উপকারের প্রতিদান উপকার
ছোট্ট একটি গ্রাম নাম নন্দীপাড়া। চারদিকে সবুজ গাছপালায় আবৃত এ গ্রাম। হালকা কুয়াশাচ্ছন্ন শীত পড়ছে, মাঠে মাঠে সোনালী ধান, কৃষকের মুখে-মুখে হাসি! এরই মাঝে বাস করত এক ছোট্ট ইঁদুর। সহজ- সরল ও দয়ালু মন ছিল ইঁদুরটির। ইঁদুরটি উপকার করতে বেশ পছন্দ করত এবং বিপদে-আপদে সবার পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করত। ইঁদুরটি যে ঘরে থাকতো সেই ঘরের মালিকের যথাক্রমে একটি মুরগি, কবুতর ও একটি ছাগল ছিল। মুরগি,কবুতর ও ছাগলের সম্পর্ক বেশ ভালোই। ইঁদুরের সাথে সামনে সামনে ভাব ভালো থাকলেও তারা ইঁদুরকে মন থেকে যেন ঘৃণা করত। ঘৃণা করার করার কারণটা ছিল তাদের মালিক তাদেরকে যত্ন করে কিন্তু ইঁদুর তো পালিয়ে পালিয়ে মালিকের ঘরে থাকে। মালিক ইঁদুরটিকে মারার জন্য অনেকবার ফাঁদ পাতলেও ইঁদুরটি মালিকের ফাঁদে পা দেয়নি এখনো।
হঠাৎ একদিন মুরগিটি বাত রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ে, কিন্তু মালিক জানত না যে মুরগিটি বাত রোগে আক্রান্ত। মুরগির শরীর দুর্বল দেখে ইঁদুর টের পেল যে মুরগির কোন না কোন সমস্যা হয়েছে। ইঁদুর মুরগিটিকে জিজ্ঞেস করল কিরে তোর কি হয়েছে? জবাবে মুরগি বলল, আমি বাতরোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েছি, আমার অনেক কষ্ট হয়। আমাকে তাড়াতাড়ি সুস্থ করার ব্যবস্থা করো। ইঁদুরটি অনেক ভাবার পর মুরগিটিকে বলল তুমি একটু বিশ্রাম নাও, আমি আসছি। সন্ধ্যা হয়ে এলো, ইঁদুরটি রাতের আঁধারে ধানক্ষেতে গিয়ে পাকা ধান নিয়ে আসলো মুরগির জন্য। অনেক রাতে এসে আস্তে আস্তে মুরগিটিকে জাগালো ও পাকা ধান খেতে দিয়ে চলে গেল। মুরগিটি ধান খেতে লাগলো এবং ধান খাওয়া শেষে আবার ঘুমিয়ে পড়লো। সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর লক্ষ্য করলো তার শরীর অনেকটা সুস্থ হয়ে গেছে! কিছুক্ষণ পর ইঁদুরটি মুরগির কাছে এসে জিজ্ঞেস করল, এখন শরীরের কী অবস্থা? জবাবে মুরগি বলল, আগের চেয়ে অনেকটা ভালো, এখন আমি মোটামুটি সুস্থ। সংবাদ পেয়ে ইঁদুরটি মনের আনন্দে তার কাজে চলে গেল।
পরেরদিন কবুতরটি মাঠে খাবার খেতে গেলো। সেখানে আরো অনেক কবুতরের ঝাঁক এসেছে। সে ভিন্ন এক ঝাঁক কবুতরের সাথে অন্য এক বাড়িতে চলে যায়। কিন্তু সে কবুতরের মালিক কবুতরগুলো বিক্রি করার জন্য হাঁটে উঠাবে বলে পরিকল্পনা করে। খবরটি ইঁদুরের কারে পৌঁছালে ইঁদুর রাতের আঁধারে কবুতরের কাছে চলে যায় এবং কবুতরকে ডাক দেয়, কবুতর ঘর থেকে বের হয়ে ইঁদুরটিকে দেখে খুব অবাক হয়! কবুতরটি ইঁদুরটিকে জিজ্ঞেস করে, এত রাতে আমার বাসায় তুই কি করিস? কিন্তু কবুতরটি জানতো না সে যে অন্যের বাসায় অবস্থান করছে। সে মনে করল সে তার নিজের বাসাতেই আছে। ইঁদুর একটু অবাক হয়ে বলল, আরে পাগল! তুই যা মনে করছিস তা না, তুই তো অন্য এক মালিকের কবুতরের সাথে চলে এসেছিস! মালিক কাল সকালে তোকে সহকারে তার সমস্ত কবুতর বিক্রি করার পরিকল্পনা করছে। এ কথা শুনে কবুতর তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরে আসলো। জীবন বাঁচানোর জন্য ধন্যবাদ জানালো কবুতরটি ইঁদুরটিকে।
কিছুদিন যাওয়ার পর একদিন দুপুরে মালিকের ছাগলটি মাঠে ঘাস খেতে যায়। ঘাস খেতে-খেতে হঠাৎ অন্য এক মালিকের ধানক্ষেতে প্রবেশ করল! ধানক্ষেতের মালিক ছাগলটিকে দেখতে পেয়ে ছাগলটিকে বন্দী করে তার বাসায় নিয়ে গেল। রাতে মালিক ভুল করে ছাগলটিকে বাহিরেই বেঁধে রাখল। ইঁদুর এই খবরটি শুনতে পেয়ে ছুটে ছাগলটির কাছে গেল ও তার ধারালো দাঁত দিয়ে দড়ি কেটে ছাগলটিকে মুক্ত করে নিজ অবস্থানে আসতে সাহায্য আসলো।
দু-তিন দিন যাওয়ার পর হঠাৎ ইঁদুরটি লক্ষ্য করলো তার মালিক কী-যেন একটা নিয়ে এসে তার স্ত্রীর সাথে পরামর্শ করছে! পরবর্তীতে সে জানতে পারলো যে, তার মানে আর কিছুই নয় —একটি ইঁদুর ধরার ফাঁদ নিয়ে এসেছে মালিক। ইঁদুরটি অনেক ভয় পেলো। সে তাড়াতাড়ি করে মুরগির কাছে গিয়ে বলল, আমাকে মারার জন্য মালিক একটি "ইঁদুর ধরার ফাঁদ" নিয়ে এসেছে! কথাটি শুনে মুরগি বললো, দেখো "যার মাথা তার ব্যথা" তোমার বিপদ তুমি সামলাও! শুধু শুধু আমাকে বলে লাভ নেই, তুমি এখন আসতে পারো।
পরবর্তীতে ইঁদুর দৌড়ে চলে গেলোকবুতরটির কাছে, কবুতরটিকে ইঁদুরটি বলল—আমাকে মারার জন্য মালিক একটি ফাঁদ তৈরি করেছে, কিছু একটা করো। বাঁচাও আমাকে! কবুতরটি বললো দেখো তোমার বিপদ তুমি সামলাও গিয়ে, আমি কিছুই করতে পারবোনা! ইঁদুরটি ভীষণ মন খারাপ হলো। শেষ পর্যন্ত নিরুপায় হয়ে ছাগলটির কাছে গেল এবং ছাগলটিকে সব খুলে বলার পর ছাগলটি সবার মত একই ব্যবহার করে ইঁদুরটিকে তাড়িয়ে দিলো। ইঁদুরের সাথে সবাই একই ব্যবহার করে এবং তাকে বাঁচাতে কেউ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় নি। কিন্তু তারা হয়তো ভুলেই গিয়েছে — তাদের সবার বিপদের সময় একমাত্র ইঁদুরটিই তাদের পাশে ছিল। ইঁদুরটি পারতো প্রথমেই পালিয়ে যেতে, কিন্তু সে দেখতে চেয়েছিল কে তার বিপদে তার পাশে দাঁড়ায়। কিন্তু কেউ তার বিপদের সাথী হলো না।
হঠাৎ রাতে ইঁদুর ধরার ফাঁদে একটি বিষাক্ত সাপ আটকে গেল, মালিকের বউ রাতের অন্ধকারে সাপের লেজ ধরে টান দিলে সাপ তাকে কামড়ে দেয়। মালিকের বউয়ের খারাপ অবস্থা দেখে মালিক ওঝাকে নিয়ে আসে। ওঝা ঔষধ হিসেবে কবুতরের জুস খেতে বলে। পরের দিন কবুতরের জুসের জন্য কবুতরটিকে জবেহ করা হলো, কবুতর এখন রান্নার পাতিলে। মালিকের বউয়ের অসুস্থতার কথা শুনে তার আত্মীয় স্বজনরা তাকে দেখতে এসেছে, তাদের মেহমানদারী করানোর জন্য মুরগীটিকেও জবেহ করা হলো, মুরগীটিও এখন রান্নার পাতিলে। ইঁদুরটি সেই কখনই পালিয়ে গেছে। দু-এক দিন পর মালিকের স্ত্রী মারা গেল, লোকদের খাওয়ানোর জন্য শেষ পর্যন্ত ছাগলটিকেও যবেহ করা হলো, ছাগলটিও এখন রান্নার পাতিলে। অবশেষে একে একে ছাগল মুরগি ও কবুতর সব শেষ হয়ে গেল কিন্তু ইঁদুর এখনো জীবিত! কয়েকদিন পর ইঁদুরটি আবার ফিরে আসলো কিন্তু কাউকে দেখতে পেল না। পরবর্তীতে সব জানতে পারলো। ইঁদুরটি মনে মনে বলতে লাগল—
"উপকার করিতে না পারিলে, করো না কখনো অপকার! মনে রেখো, উপকারের প্রতিদান শুধুই উপকার"
মুরাদ হাসা্ন
তামিরুল মিল্লাত কামিল মাদরাসা, ঢাকা।
Mobile:০১৬২৬১১৭৬৮৬
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: