ঢাকা রবিবার, ১৩ই অক্টোবর ২০২৪, ২৮শে আশ্বিন ১৪৩১


আবদুল হাই শিকদার

আমাদের টম কে জানো?


আবদুল হাই শিকদার

এক.
এশার ফোন। ‘বাপা, তাড়াতাড়ি বাসায় আস।’
রওশন সাহেব বললেন, ‘ব্যাপার কী?’
‘সমস্যা।’
‘কী সমস্যা?’
‘গভীর সমস্যা।’
‘খুলে বল।’
‘আহ বাপা, খুব বিপদ। ক্রসফায়ার সমস্যা। বাসায় আসো, তারপর সব শুনবে।’
রওশন সাহেবের অন্য কোথাও যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু মেয়ের ফোন
পেয়ে ঘরেই ফিরলেন।

দুই.
সারা বাড়ি অন্ধকার। আরও অন্ধকার মুখ করে গাড়ি-বারান্দায় চুপচাপ বসে আছে অভি আর এশা। এশার পাশে মারজান। মারজানের পাশে হৃদিতা। প্রসন্নী, নাফিসা, সুমাইয়া। অভির পাশে শামী। শামীর পাশে নাইম। তারপর ফাহিম, পিয়াস ও রাকিন। রীতিমত গোলটেবিল বৈঠক। পরিস্থিতি গুরুতরই তাহলে।

রওশন সাহেবকে দেখে হাঁফ ছাড়ে সবাই। বারজন এক সাথে বলে ওঠে, ‘বাঁচলাম’!

সমস্যার মূলে একটা কুকুরছানা। অভি এশাদের হারম্যান মেইনার স্কুলের গেটের দক্ষিণ পাশে কিছুটা বাগান বাগান জায়গা আছে। মূল সড়ক আর কলেজের মাঝখানে। সেখানে ফুটপাথ ঘেঁষে কুই কুই করে কাঁদছিলো ছানাটি। গাড়ির হর্ন শুনলে কিংবা কাউকে দেখলেই ভয় পেয়ে দৌড়ে ঢুকে যাচ্ছিল ঝোপে। আবার একটু সাহস করে বেরিয়ে আসছিলো। কখনও ফুটপাথে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদে। স্কুল ছুটির পর গাড়ির জন্য অপেক্ষা করতে গিয়ে ছানাটি চোখে পড়ে অভির। সাদার মধ্যে হলুদ ডোরাকাটা দাগ। বাঘের কাছাকাছি প্রায়। অন্য কুকুর ছানার চাইতে বেশ আলাদা। দেখতে মিষ্টি।

বেশ কিছুক্ষণ বিষয়টা ফলো করে অভি। বুঝতে পারে মাকে হারিয়েছে সে। এখন ভয় পেয়ে গেছে। অন্য কুকুরের ভয়। গাড়ি চাপা পড়ার ভয়। কারোর ওপর নির্ভর করতে না পারার ভয়। নির্ভর করার মতো কাউকে না পাওয়ার ভয়। সব মিলিয়ে এক ধরনের অসহায়তায় ধুকপুক করছে।

টিফিন বক্স থেকে একটা কেক বের করে অভি। তু তু করে ডাকে। প্রথমে দেখতে পায়নি। তারপর হয়তো ইঙ্গিতটা বুঝতে পারে। দূর থেকে লোলুপ চোখে এগিয়ে আসে ছানাটি। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে অভির দিকে। অভিকে বোঝার চেষ্টা করে। অভি আবার তু তু করে খাবার দেখায়। এবার দ্বিধা বা সন্দেহ দূর হয় ছানাটির। অভির হাত থেকেই ছোট ছোট কামড়ে খেতে থাকে কেক। খাওয়া হয়ে যায়। কৃতজ্ঞতায় অভির হাতের আঙুল চাটতে থাকে। আর ছোট্ট লেজটি একটু একটু নাড়ে।

অভি বলে, ‘হ্যারে টোকাই তুই কি যাবি আমার সাথে’?

ছানাটি কিছু বলে না। খালি লেজ নাড়ে।
এর মধ্যে এশা চলে আসে। গাড়িও চলে আসে।
এশা বলে, ‘ভাইয়া, তুই কোথায় পেলি ওকে? ভারি সুন্দর তো’।
অভি বললো, ‘পেলাম তো এখানে। মা হারা। খুব ক্ষুধার্ত ছিল। এখন কী করি বলতো?’

এভাবে এক মিনিট। তারপর ঝট করে কুকুর ছানাটিকে কোলে তুলে নেয় অভি। চলে আসে বাড়িতে।
প্রথমে অভি আর এশা ভেবেছিল কিছুদিন লুকিয়ে রাখবে গ্যারাজে। কিন্তু ড্রাইভার সেকেন্দার ঘণ্টাখানিকের মধ্যে সব ফাঁস করে দেয়। এমনি ফোঁস করে ওঠেন মা।
‘কি পথের কুকুর কোলে করে এনেছ বাড়িতে? আমার গাড়িতে চড়িয়ে! ছি ছি ছি ?’
এক্ষুনি দূর কর এ আপদ।’
মা হাঁকলেন, ‘কাঞ্চন!’

কাঞ্চনের সাথে সাথে এলো জাকির। জাকিরের পেছনে জমিলা বু।
মা বললেন, ‘এই কুত্তার বাচ্চাটাকে রাস্তায় ফেলে দিয়ে আয়। আর অভি আর এশাকে ডেটল গোলা পানিতে চুবিয়ে রাখ।’
অভি বললো, ‘মা প্লিজ। একটা কথা শোন।’
মা বললেন, ‘না, কোন কথা নয়। পথের কুকুর বাসায় থাকবে এ হতে পারে না। সবাই জলাতঙ্ক রোগে মরবো নাকি?’
এশা বললো, ‘মামণি তুমি কিন্তু খুব অন্যায় করছো।’
‘কিসের অন্যায়?’
‘একটা অসহায় কুকুর ছানা, রাস্তায় পড়ে পড়ে কাঁদছিলো।’
‘কাঁদছিলো বেশ করছিলো। তাই বলে বাসায় নিয়ে আসতে হবে। তাও আবার কোলে করে ! ছি ছি ছি!’

মা দড়াম করে দরোজা বন্ধ করে দিলেন। দুই ভাইবোন গালে হাত দিয়ে বসে রইল বারান্দায়। কুকুর ছানা তো এত সব হাঙ্গামা বোঝে না। সে কতক্ষণ অভির গাল চাটে। কতক্ষণ এশার ওড়নার প্রন্ত নিয়ে খেলা করে। আবার বাগানে প্রজাপতি দেখে লাফিয়ে লাফিয়ে ছোটে সেটার পেছনে।
অভি আর এশা তাদের সব বন্ধুকে খবর দিল। যে যেখানে আছিস ছুটে যায়। বিপদে পড়েছি।

মা চাচ্ছেন কুকুরমুক্ত বাড়ি।
আমরা চাচ্ছি কুকুরযুক্ত বাড়ি।
বন্ধুরা সমস্যার কূলকিনারা করতে হিমশিম খাচ্ছে।
তোদের আব্বুকে খবর দে। তার আগে গোলটেবিলের সিদ্ধান্ত কুকুরটার একটা নাম ঠিক করা দরকার। বারবার কুকুরছানা কুকুরছানা শুনতে ভাল লাগছে না। আর আজকের এই বৈঠকেরও একটা শিরোনাম চাই।

অনেক ভেবেচিন্তে বৈঠকের শিরোনাম রাখা হলো ‘টম’ রক্ষা আন্দোলন : আজকের করণীয়’।
হৃদিতা বললো, ‘ওর নাম “জ্যাক”।’
নাফিসা বললো, ‘না, জ্যাক নয় ও “জন”।’
শামী বললো, ‘ওর নাম রাখ “পথকলি”।’
মারজান তো হেসেই খুন।
‘না ওর নাম রাখ “বাঘা”। বাঘা মিয়া।’
প্রসন্নী বললো, ‘কী যে বল, কুকুরের নাম বাঘা হয় কী করে? ওর নাম রাখো “ওয়েস্ট লাইফ”।’
রাকিন বললো ওয়েস্ট লাইফ! ধ্যাস!’

সুমাইয়া, পিয়াস, পিয়াল একসাথে রে রে করে উঠলো, ‘এত সুন্দর একটা কুকুর ছানার এ রকম পচা নাম হতে পারে না। সবাই, তাহলে.’ এশা বললো, তাহলে ওর নাম হতে পারে ‘টম’। রাজশাহীর ‘টম টম’ থেকে একটা ‘টম’।
আর আঙ্কেল টমস কেবিন থেকে ও ধার নেয়া হবে।’
শামী বললো, ‘কুকুরের নাম টম না, ওর নাম রাখ ‘টং’। ও যেন সব সময় রেগে টং হয়ে থাকে।’
মারজান বললো, ‘তাহলে তুমি হবে ওর হিজ মাস্টার্স ভয়েজ।’
আরও বহু গবেষণা হলো। আলাপ হলো।
ভোট হলো। ‘টম’ জিতে গেল।

তিন.

আজ। চমৎকার রান্না।’
বুলার মুখে কোন কথা নেই।
রওশন সাহেব বললেন, ‘যাই বলো বুলা।’
মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বুলা বললেন, ‘দ্যাখো। আমি তোমাকে সাফ সাফ বলে দিচ্ছি, আমার বাসায় আমি পথের কুকুর অ্যালাও করবো না।’
এক সঙ্গে গলায় ভাত আটকে যায় অভি ও এশার। সাহায্য চাওয়া চোখে দু’জন তাকায় রওশন সাহেবের দিকে।

রওশন সাহেব বললেন, ‘ভালো কথা। ঠিকই তো। পথের কুকুর বাসায় থাকবে তা কি হয়। বিলাতি টিলাতি হলে তাও কথা ছিল। একেবারে নেড়ি কুকুরের বাচ্চা।’
হাল ছেড়ে দেয় অভি ও এশা। ডাইনিং টেবিলের চারদিকে নামে পিনপতন নীরবতা। কেবল খাওয়ার শব্দ। হঠাৎ খাওয়া বন্ধ করে রওশন সাহেব বলেন, ‘তবে কুকুরের কিন্তু অনেক প্রতিশব্দ আছে। জানো?’

এশা চাপা গলায় বললো, ‘বাপা’

রওশন সাহেব বললেন, ‘সারমেয়, শ্বা, কুক্কুর, শুন, শুনি, বকারী, কালেয়ক, ভষণ, ভষক, শয়ালু শব্দগুলো কিন্তু কুকুরকেই বোঝায়’।
বুলা বললেন, ‘সে তো বুঝলাম, কিন্তু এ আপদ কি তুমি গ্যারাজে রাখতে বলেছ?’
রওশন সাহেব বললেন, ‘হ্যাঁ, না, তা হয়তো বলেছি। কিন্তু বলার পেছনে আছে একটা ইতিহাস। আছে ঐতিহ্য। মানুষের সবচেয়ে বড় সমস্যা, সে ইতিহাস সৃষ্টি করে। কিন্তু ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে না। এই ভুলের যাতে পুনরাবৃত্তি না হয় সেই জন্য কুকুরের গ্যারাজবাসের সিদ্ধান্ত।’
বুলা বললেন, ‘দ্যাখো চ্যান্স পেলেই তুমি এই যে জ্ঞান দান করো এ কিন্তু আমার অসহ্য। গা জ্বলে যায়।’
রওশন সাহেব বললেন, ‘মানে তা ঠিক নয়। এ হলো ইতিহাস। সত্যিকারের ইতিহাস’।
বুলা বললেন, ‘রাখো তোমার ইতিহাস।’

রওশন সাহেব গলা কেশে বললেন, ‘শোনাই না। একটু মন দাও। বন্য প্রাণীর মধ্যে যে প্রাণী সেই মধ্যপ্রন্তর যুগে মানুষের কাছে এসেছিল, মানুষকে ভালোবেসেছিল সে কিন্তু কুকুর। অন্য কোন প্রাণী নয়। ব্যাপকভাবে মানুষ কুকুর প্রতিবেশী, বন্ধু হয়ে ওঠার আক্ষরিক বয়সও ১৪ হাজার বছরের কম নয়। এই যে চৌদ্দ হাজার বছরÑ সেই থেকেই এরা পরস্পরকে সাহায্য করে এসেছে। কুরআন শরীফে আসহাবে কাহাফের যে কাহিনী, সেখানেও কিন্তু গুহাবাসীদের সাথে ঘুমিয়ে আছে অত্যন্ত প্রভুভক্ত সাহসী একটি কুকুর। বলা হয়, এদের ঘুম পৃথিবীর ধ্বংসের দিন ভাঙবে।

‘মহাভারত’ একটা বিখ্যাত মহাকাব্য। এই মহাকাব্যের অন্যতম নায়ক যুধিষ্ঠির। দেবরাজ ইন্দ্র এসে বললেন, রথ প্রস্তুত। এতে চড়ে আপনি এখন স্বর্গে চলে যান।’
যুধিষ্ঠির তার কুকুরটিকে নিয়ে রথে উঠতে গেলেন।
ইন্দ্র বললেন, ‘না, না, কুকুর তো স্বর্গে যেতে পারবে না
যুধিষ্ঠির বললো, ‘প্রিয় কুকুর ছাড়া আমিও যাচ্ছি না।’
অগত্যা কুকুরসহ যুধিষ্ঠিরকে রথে চাপাতে বাধ্য হলেন ইন্দ্র।’
বুলা বললো,‘ এই সব কাহিনী আমাকে শোনানোর অর্থ কী?’

‘অর্থ এমন কিছু নয়। শুধু এই কথাগুলি বলা যে, কুকুর খুব প্রভুভক্ত প্রাণী। কোনক্রমেই প্রভুর বিরুদ্ধে কোন কাজ তাকে দিয়ে করানো সম্ভব নয়। কুকুর অতি সহজে পোষ মানে। এদের মধ্যে কোন পাপচিন্তা নেই। গৃহপালিত কুকুর সবসময় সাহস, বল, বুদ্ধিবৃত্তি নিয়ে প্রভুর উপকার করে। একটি কুকুর একটি দারোয়ানের কাজ করে। এরা অনেক খেতে পারে। কিন্তু সামান্য কিছু পেলেই খুশি হয়। কুকুরের ঘ্রাণ শক্তি খুব তীব্র। দৌড়েও এদের দক্ষতা অনেক। এরা প্রভুর জন্য শিকার ধরে দেয়। শিকার করে দেয়।’
অভি ঘাড় নিচু করে খেতে খেতেই বললো, ‘বাপা তুমি লাইকার কথা শুনেছো?’
এশা বললো, ‘এ তো আমিই জানি। লাইকা হলো পৃথিবীর একমাত্র কুকুর যে রকেটে চড়ে মহাকাশ ভ্রমণ করেছে এটি ছিল একটি রুশ কুকুর ।’
অভি বললো, ‘ভেরি গুড।’

রওশন সাহেব বললেন, ‘কুকুরের আরও গুণের কথা বলি। কুকুর সিসমোগ্রাফের আগেই ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দিতে পারে।’
অভি বললো, ‘আমার স্যার বলেছেন কুকুর নাকি ভূতদের দেখতে পায়?’
‘ঠিক দেখতে পায় কি না জানি না। তবে ধারণা করা হয় কুকুর অতনু বা অশরীরীদের উপস্থিতি টের পায়। এরকম একটি গল্প আছে আর্চিবল্ড বাটলেজ এর লেখা ‘ক্রাইম মিস্ট্রি অ্যান্ড ডিটেকশন’ বইয়ে। অতএব,
এশা বললো, ‘মামনি ওকে প্রতিদিন শ্যাম্পু করে গোসল করানোর দায়িত্ব আমার’।
অভি বললো, ‘ওকে বাইরে নিয়ে টয়লেট করানোর অভ্যাস করার ভার আমার’।
রওশন সাহেব বললো, ‘আর পশু হাসপাতাল থেকে জলাতঙ্কের ইনজেকশন দিয়ে আনার কাজটি করছি আমি।
এতক্ষনে এশা বললো, ‘মামণি, আমার সত্যিই সোনা’
অভি বললো,এতক্ষন.’
তিনজনে জোড় হাতে বুলার দিকে তাকিয়ে।
বুলার মন তবু গলে না, ‘যা খুশি কর। তবে ওটাকে আমি ঘরে ঢুকতে দিচ্ছি না।’
তিনজন একসঙ্গে ‘হিপ হিপ হুররে, বুলা ধমকে ওঠেন, ‘অনেক হয়েছে। এবার টেবিল ছাড়’।
গ্যারেজ থেকে টমের ছোট হঙ্কার শোনা গেল, ‘ঘেউ ঘেউ ঘেউ’।

চার.
এশা আর অভি স্কুলে গিয়ে অবাক! স্কুলে সবার মুখে মুখে টমের কাহিনী। টিফিন আওয়ারে হৃদিতা বললো, ‘হ্যারে, তোর আম্মুর মাথা ঠান্ডা হয়েছে?’
মারজান বললো, ‘যা ভয় পেয়েছিলাম!’

শামী বললো, ‘অভির ফোন পেয়ে ভেবেছিলাম না জানি কী হয়েছে। গিয়ে দেখি কুকুর! তা যাই বলিস, তোর আম্মুর রণরঙ্গিনী ভাবসাব দেখে ভাবছিলাম পালাই।’
রাকিন বললো, ‘কিন্তু আমার বেশ মজাই লাগছিলো।’
নাইম বললো, ‘তা তো লাগবেই। জন্মদিনে তোকে যে একটা কী কলম উপহার দিয়েছিল নাÑ সেই জন্য।’
রাকিন বললো, ‘মোটেই না।’

এশা বললো, ‘এর মধ্যে এক কাজ। মামণির তো সকালে ওঠার অভ্যাস। তারপর বাগানে কিছুক্ষণ পায়চারি করেন। আজও করছিলেন। টম যে কখন মামণির পেছনে পেছনে হাঁটছিলো টেরই পাননি। তারপর মামণি থামলে পায়ের ওপর গিয়ে বসে, গায়ের সাথে গা লাগিয়েছে। আর যায় কোথায়? চিৎকার চেঁচামেচি। আমার শাড়ি নষ্ট হলো! ওজু নষ্ট হলো! ইত্যাদি ইত্যাদি। লাফিয়ে চলে আসে বারান্দায়। টমও এক লাফে বারান্দায়। মামণি ঢুকেছে ঘরে। টমও দৌড়ে ঢুকে পড়েছে ঘরে। মামণি যেদিকে যেদিকে যায় টমও সেদিকে সেদিকে যায়। যা হাউ কাউ।’

হাসির হররা ছড়িয়ে পড়ে ডাইনিং স্পেস থেকে টানা বারান্দায়।
নাইম বললো, ‘যাই বলিস তোর মামণি একটা জিনিস।’
অঙ্ক স্যার ক্লাসে ঢুকেই, ‘ক্লাসে এতো হাসাহাসি হচ্ছে কেন?’
সুমাইয়া বললো, ‘স্যার এশারা একটা কুকুর ছানা কুড়িয়ে পেয়েছে। তাই নিয়ে ওদের বাসায় যা গÐগোল!’
স্যার বললেন, গÐগোলের কী আছে? ভালো তো, ওটাকে এখন ট্রেনিং দিয়ে নাও।’
মারজান বললো, ‘স্যার কুকুর আপনি পছন্দ করেন?’
‘পছন্দ করবো না কেন? তবে আদিখ্যেতা ভালো লাগে না।’
প্রসন্নী বললো, ‘স্যার কুকুর নিয়ে ভালো একটা গেম পাওয়া যায় ‘ডেড টু রাইড।’ আপনি কি দেখেছেন?’
স্যার বললেন, ওসব গেম টেম আমি দেখিনি। তবে কুকুর কী করে মানুষের পোষ মানলো, বন্ধু হলো, তার একটা গল্প আছে মনিপুরের নাগা উপজাতির মধ্যে। সেটা জানি।’
নাফিসা বললো, ‘স্যার গল্পটা বলুন না!’
‘অংকের ক্লাসে কুকুরের গল্প!’
সবাই সমস্বরে বললো, ‘বলুন না স্যার।’

স্যার চক ডাস্টার টেবিলে রেখে চেয়ারে বসলেন, ‘ঠিক আছে শোনো। এটা কিন্তু নিছক একটা গল্প। সে কবেকার কথা কে জানে। গহিন বনের ধারে একটা স্ত্রী কুকুর তার ছোট ছোট দু’টি বাচ্ছা নিয়ে বাস করতো। বাচ্চা দুটো যখন কেবল একটু বড় হয়েছে, সেই সময় একটা পাগলা হরিণ একদিন ওদের মাকে শিং দিয়ে গুতিয়ে মেরে ফেলে। বাচ্চা দু’টি এতে খুব ব্যথা পেল। এখন কে তাদের খাওয়াবে? কে দেখবে? তারা মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলো, এই অন্যায়ের শোধ তারা নেবে। কিন্তু কি ভাবে? তারা তো ছোট। ঘুরতে ঘুরতে তারা একদিন এক শক্তিশালী হাতির কাছে গেল। সব খুলে বললো। হাতি হরিণটিকে শাস্তি দিতে রাজি হলো। খুশি হয়ে দুই বাচ্চা কুকুর ‘ঘেউ ঘেউ’ করে ডেকে উঠলো। কিন্তু হাতি এতে বিরক্ত হলো। কারণ এই আওয়াজ শুনে যে কোন সময় বাঘ কিংবা সিংহ চলে আসতে পারে। তাহলে সবার জীবনই বিপন্ন হবে। হাতি রাগ করে ছোট কুকুর দু’টিকে তাড়িয়ে দিল।

খুব মন খারাপ করে দুই ভাই গেল এবার এক বাঘের কাছে। মাতৃ হত্যার প্রতিশোধ নিতে বাঘের সাহায্য চাইল। সব শুনে বাঘ ধীর স্থিরভাবে সম্মতি জানালো। মা হারা দুই কুকুর ছানা এবারও খুশি হয়ে ঘেউ ঘেউ করে ডেকে উঠলো। তাদের ঘেউ ঘেউ শুনে বাঘ গেল ভয় পেয়ে। সে ভাবলো, ‘সেরেছে, এরা দেখি আমাকে বিপদে ফেলে দেবে। এই ডাকাডাকি শুনে যে কোন মুহূর্তে মানুষ চলে আসতে পারে। এলেই বিপদ। মানুষ তাকে মেরে ফেলতে পারে। অনেক ভেবে টেবে বাঘ বললো, ‘এ কাজ আমি পারবো না। তোমরা এখন চলে যেতে পার।’

মনের দুঃখে দু’ভাই চিরদিনের জন্য বন ত্যাগ করে এক গ্রামে চলে এল। গ্রামের বাইরে এক প্রাচীন বটগাছের তলায় বসে বসে কাঁদতে লাগলো দু’ভাই। সেসময় সেখান দিয়ে যাচ্ছিলেন একজন মানুষ। তার খুব মায়া হলো। সে কুকুরছানা দুটিকে বাড়ি নিয়ে এলো। আদর করে খাবার দিল। ক্ষুধার্ত ছানা দু’টি বহুদিন পর পেট পুরে খেল।
তারপর মানুষটি জানতে চাইলো, তারা কাঁদছিলো কেন?

ছানা দু’টি তাদের সকল কাহিনী মানুষটিকে বললো। মানুষটি সব শুনে অত্যান্ত সহানুভূতির সাথে বললো, নিশ্চয়ই আমি তোমাদের সাহায্য করবো। এই খুনের প্রতিশোধ নেব। কুকুর ছানা দু’টির সাথে কোনদিন কেউ এত ভালো ব্যবহার করেনি। ফলে খুশি হয়ে ঘেউ ঘেউ করে কৃতজ্ঞতা জানালো। ছানা দু’টি আরও একটু বড় হলো। তারা সারা বাড়ি ঘুরে বেড়ায়। রাত জেগে মানুষটির বাড়ি পাহারা দেয়। অস্বাভাবিক কোন কিছু দেখলেই চিৎকার শুরু করে। শিয়ালদের তাড়িয়ে মানুষটির মুরগি রক্ষা করে। মানুষটি কখনও কোন খাবার দিলে পা চেটে, লেজ নেড়ে ধন্যবাদ জানায়। এতে ওদের প্রতি মানুষটি আরও খুশি হলো। ধীরে ধীরে কুকুর ছানা দু’টি বড় হলো। হলো আরও সাহসী। আরও বিনয়ী। তারা মানুষের সমাজে বসবাসে অভ্যস্ত হয়ে উঠলো।

দিন যায় মাস যায়। কুকুর দু’টি কিন্তু তাদের প্রতিজ্ঞার কথা ভূলেনি। তারা আবার একদিন মানুষটিকে সে কথা মনে করিয়ে দিল।
মানুষটি বললো, ‘তাইতো, অনেক দেরি হয়ে যাচ্ছে। চল বনে যাই। পাগল হরিণটিকে খুঁজে বের করি।’
একদিন কুকুর দু’টিকে নিয়ে মানুষটি বনে গেল শিকারে। বনের এদিকে ওদিকে অনেক ঘুরাঘুরি করে অবশেষে কুকুর দু’টি সেই হরিণটাকে খুঁজে পেল। মানুষটি বল্লম হাতে নিয়ে ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে রইল। আর কুকুর দু’টি তীর বেগে হরিণটিকে তাড়া করলো। কুকুর দু’টির তাড়া খেয়ে হরিণটি ওই ঝোপের কাছ দিয়ে ছুটে পালাচ্ছিল। সেই সময় মানুষটি তার হাতের বল্লম ছুড়ে হরিণটিকে মেরে ফেললো।

কুকুর দু’টি এই ঘটনায় লেজ নেড়ে নেড়ে মানুষটিকে কৃতজ্ঞতা জানালো। এরপর মানুষের সাথে কুকুরের বন্ধুত্ব আরও বেড়ে গেল। কুকুর দু’টি মানুষের সঙ্গে বসবাস করতে রাজি হয়ে গেল। তারা আর বনে ফিরে গেল না।’ সেই থেকে কুকুররা মানুষের সাথে থাকে। মানুষ তাদের আদর করে। বিনিময়ে মানুষের অনেক উপকার করে কুকুর।’
স্যার বললেন, ‘আমার গল্প শেষ।’
এর মধ্যেই ঢং ঢং। ক্লাস শেষের ঘণ্টা বাজালো।

পাঁচ.

নিউইর্য়ক থেকে রওশন সাহেবের ফোন পেয়ে মহাখুশি এশা, ‘বাপা তুমি ভালো আছো তো?’
‘হ্যাঁ। খুব ভালো আছি। এই কিছুক্ষণ আগে এসে পৌঁছুলাম।’
‘তোমার সেমিনার কখন?’
‘আগামীকাল। তা তোরা ভালো তো সবাই?’
‘হ্যাঁ বাপা।’
‘অভি কোথায়?’
‘ভাইয়া গেছে শামী ভাইয়াদের বাসায়। শামী ভাইয়ার জন্মদিন তো তাই। আজ রাতে ওখানেই থাকবে।’
‘তাহলে দেখা যাচ্ছে অভি বড় হয়ে গেছে। এখন একা একা বাইরে থাকতে পারে।’
‘আচ্ছা বাপা তোমার সেমিনার কী নিয়ে?’
‘এটা আমার একলার সেমিনার নয়। এটা হলো সব দেশের প্রতিনিধিদের নিয়ে। এর প্রধান লক্ষ্য হলো কী করে আমরা আমাদের এই পৃথিবীকে আরও সুন্দর করতে পারি-তাই নিয়ে।
এটা মূলত পরিবেশ বিষয়ক একটা বিশ্ব সেমিনার।’
‘আচ্ছ বাপা, তুমি কি স্ট্যাচু অব লিবার্টি দেখতে যাবে?’
‘হ্যাঁ, যাব।’
‘তাহলে আমার জন্য অনেক ভিউকার্ড নিয়ে আসবে। আর তোমার ছবি চাই স্ট্যাচু অব লিবার্টির সাথে।’
‘মঞ্জুর। তা মামণি কোথায়?’
‘মামণিকে দিচ্ছি। তার আগে শোন কুকুর নিয়ে অনেক মজার মজার ছবি আছে ওদেশে। মুভি। বুঝেছ! তাই বলে আর ‘স্কুবিডু’ নয়। নিয়ে এস টমের জন্য।’
‘তা টম কী করছে?’

‘টম যা পাজি হয়েছে বাপা তুমি জানো না। কাল কি করেছে শোন। স্কুলে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছি। আমার স্কুল সু-এর এক পাটি পায়ে দিয়েছি। অন্য পাটি মুখে নিয়ে টম হাওয়া। আমি কিছুতেই ধরতে পারি না। শেষে কাঞ্চন ভাই ওকে ধরেছে। কিন্তু সু-যে কামড়ে ধরেছে। কিছুতেই ছাড়বে না। কি করি বলো তো!
তারপর আমার একটা মিমির খাওয়ার লোভ দেখিয়ে সু পেলাম। ভ্যাগ্যিস মামণি কাছে ছিল না! থাকলে ঘরে ঢোকার শাস্তিপেত নির্ঘাত।
‘তাহলে তো বেশ পাজি হয়েছে!’
‘খালি পাজি নয়। পাপাঝা! পাজির পা ঝাড়া। ভাইয়ার পড়ার টেবিল সবসময় এলোমেলো করে দেয়। ক্রিকেটের বল নিয়ে খামাখা ছুটাছুটি করে। পেছন থেকে প্যান্ট কামড়ে ধরে।
আচ্ছা বাপা পাখিদের সাথে ওর কি কোন আড়ি আছে?’
‘কেন বল তো?’

‘ওর জন্য বাগানে একটা কাক পর্যন্ত বসতে পারে না। সারাক্ষণ দাবড়ে নিয়ে বেড়ায়। আচ্ছা বাপা, তুমি কি টমের ঘেউ ঘেউ শুনতে পাচ্ছ?’
হো হো করে হাসলেন রওশন সাহেব, ‘হ্যাঁ শুনতে পাচ্ছি। তা টম কি তোমার ঘরে?’
‘ঘরেই তো। কিন্তু টম খুব জ্বালাচ্ছে। মামণি একটু আড়াল হলেই ও ঘরে ঢুকে আমার বই খাতা যা পায় তাই নিয়ে পালায়।’
এ সময় বুলা ঘরে ঢুকলো, ‘কার সাথে কথা বলছো?’
‘বাপার সাথে।’
‘দাও, আমাকে দাও।’

ছয়.

সাধারণত গাড়ির একটা হর্ন পেলেই গেট খুলে দেয় কাঞ্চন ভাই। কিন্তু তিন বার হর্ন দেয়ার পরও গেট খুললো না। সেকান্দার গাড়ি থেকে নেমে গেট খুললো। এশা একটু অবাক হলো। গাড়ি থেকে নামার আগেই প্রতিদিন দৌড়ে কাছে এসে ঘেউ ঘেউ শুরু করে দেয় টম। পেছনের দুই পায়ের ওপর ভর দিয়ে এশার হাত ছুঁতে চায়। ছুটাছুটি করে। লেজ দুলিয়ে, কান দু’টি একটু নাড়িয়ে কোলে উঠতে চায়। আজ টমও নেই। ব্যাপার কী?
এ সময় জমিলাবুর দেখা পাওয়া যায়, ‘আপা গো সর্বনাশ অইচে!’

ছ্যাৎ করে ওঠে এশার বুক। তারপর হড়বড় করে জমিলাবু যা জানালো, তার সারাংশ হলো, প্রতিদিনের মতো যে যার কাজ করছিলো। টম খেলছিল বাগানে। এ সময় পাড়ার একটা ডানপিটে ছেলে দেয়াল টপকে ঢুকে পড়ে বাগানে। আর যায় কোথায়! টম তার খেলা ফেলে তেড়ে যায় ছেলেটার দিকে। শুরু করে ঘেউ ঘেউ চিৎকার। বিষয়টা চোখে পড়ে কাঞ্চনের। কিন্তু কাছে যাওয়ার আগেই টমকে জোর করে ধরে দেয়াল টপকে হাওয়া হয়ে যায় ছেলেটি। কাঞ্চনের হাঁকডাকে ছুটে আসে জাকির। জমিলাবু। মা মণি। টমকে চুরি করে নিয়ে গেছে একটা বখাটে ছেলে। মামণি ভয়ানক রেগে গেলেন। এখন সেই টমকে উদ্ধারের জন্য ছুটে গেছে কাঞ্চন, জাকির। এমনকি মামণিও। তাও প্রায় ঘণ্টাখানেক হলো। তারপর আর কেউ ফিরে আসেনি।

মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে এশার। এশার প্রথমেই মনে হলো অভি ভাইয়ার কথা। কিন্তু ভাইয়া তো মৌচাকে স্কাউট জাম্বুরিতে গেছে। ফিরে আসতে আরও একদিন। এখন উপায়? বারান্দায় গুম হয়ে বসে রইল এশা। হঠাৎ পুরো বাড়িটা শূন্য মনে হলো এশার। মনে হলো, ওর সব শেষ হয়ে গেছে। সব কিছু ফাঁকা ফাঁকা লাগতে শুরু করে।

বিদ্যুৎ ঝলকের মতো ওর মাথায় এলো এসপি মামার কথা।
অমনি ছুট টেলিফোনের কাছে।
‘মামা তুমি কোথায়?’
‘কেন’
‘মামা, তুমি তাড়াতাড়ি চলে আস। আমাদের সব শেষ হয়ে গেছে?’
টেলিফোনের ওপার থেকে আঁৎকে ওঠেন মামা, ‘কী, কী হয়েছে!’
‘মামা, আমাদের টমকে চুরি করে নিয়ে গেছে পাড়ার একটা দুষ্টু ছেলে। তুমি তাড়াতাড়ি আস।’
‘টমটা কে?’
‘মামা আমাদের টমকে তুমি জানো না?’
‘না তো!’
‘মামা টম আমার জান। আমার কুকুর ছানা।’
‘ও তাই বল।’ মামা দম নেন।
‘মামা তুমি তাড়াতাড়ি আস। রাগে দুঃখে আমার কান্না পাচ্ছে।’
‘ঠিক আছে আসছি।’

টেলিফোন ছেড়ে আবার বারান্দায় চলে আসে এশা। গুম হয়ে বসে থাকে। মনে মনে বলে টমকে না পেলে আমি খাব না। স্কুলে যাব না। কথাও বলবো না। এভাবে কতক্ষণ কে জানে! হঠাৎ গেটের দিকে শোরগোল শুনে ঘোর কাটে এশার। দেখে পাড়ার লোকজন কথা বলতে বলতে তাদের বাসার দিকে এগিয়ে আসছে। একটা ছেলেকে কান ধরে টেনে আনছে কাঞ্চন ভাই। আর মা মনির কোলে টম। লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ায় এশা।

মামণি কাছে এসে বললেন, ‘দেখ এই বদ ছোকড়াটা আমাদের টমের কী দশা করেছে। ওকে না খাইয়ে রেখেছে। নোংরা করে ফেলেছে।’
টম মা মনির কোল থেকে এশার দিকে তাকিয়ে ‘ঘেউ ঘেউ’ করে ওঠে।

খুশিতে ভেউ ভেউ করে কেঁদে ফেলে এশা।



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Top