,

শহীদ আবু সাঈদ | দ্রোহ, বিপ্লব আর সাহসের প্রতিচ্ছবি


আবুল মনসুর আহমদ [১৮৯৮-১৯৭৯] ছিলেন উপমহাদেশের প্রখ্যাত সাহিত্যিক, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ ও আইনজীবী। একাধারে এতগুলো ক্ষেত্রে অবদান রেখে যাওয়ার নজীর ইতিহাসে খুব বিরলই বলতে হবে। তিনি তাঁর আত্মজীবনী ‘আত্মকথা’র ভূমিকায় জীবন সম্পর্কে তুলে ধরেছেন বেশকিছু অসাধারণ উপলব্ধি। তিনি লিখেছেন, ‘আত্মজীবনী লেখা মানে জীবন পথে পিছন ফিরিয়া দেখা। যাঁরা বিনা ঝড় তুফানে নিরাপদে স্বাচ্ছন্দ্যের পানসিতে চড়িয়া জীবন-নদী পার হইয়াছেন, তাঁদের পিছন ফিরিয়া দেখিবার কিছু নাই। সুতরাং আত্মজীবনী লিখিবারও কিছু থাকে না। এই দিক হইতে বিচার করিলে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের নিরাপদ জীবন আসলে কোনো জীবনই নয়। অথচ বিপুল অধিকাংশের জীবনই এমনি ধরণের বৈচিত্র্যহীন মামুলি জীবন। কাজেই সমাজের দিক হইতে অর্থহীন জীবন।’

তিনি আরও লিখেছেন, ‘কিন্তু সংসারের প্যারাডক্স এই যে, আমরা অধিকাংশই এমনি জীবন যাপন করিতে চাই। বিষয়ী লোকের বিবেচনায় এটাই আদর্শ জীবন। কাজেই এমন নিরাপদ জীবনই অধিকাংশের কাম্য। যাঁরা এর ব্যতিক্রম, যাঁদের জীবনসংগ্রাম সংঘাতপূর্ণ, নিরাপদ জীবন ইচ্ছা স্বত্বেও যাঁরা যাপন করিতে পারেন নাই, ঝড়-তুফানের সঙ্গে লড়াই করিয়া যাঁদের জীবন কাটিয়াছে, ভব-নদী পার হইতে গিয়া যাঁদের জীবন-তরী ডুবি-ডুবি করিতে করিতে কিনারা লইয়াছে, তাঁদের মধ্য হইতেই সাধারণত আত্মজীবনী লেখার যোগ্য ও অধিকারী লোকের আবির্ভাব।’ সত্যিই তাই! আবুল মনসুর আহমদের বর্ণিত এই বিশেষ মানুষগুলো আত্মকেন্দ্রিকতার ঊর্ধ্বে উঠতে পারেন। কেবল নিজের নিরাপদ ভবিষ্যতের কথা না ভেবে দণ্ডায়মান হন সত্য প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে। মিথ্যার বিরুদ্ধে গর্জে ওঠে তাঁদের বজ্রকণ্ঠ।

নিছক আত্মপ্রতিষ্ঠাকে যারা জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করেছে, যাদের চিন্তা-চেতনা, ধ্যান-জ্ঞান কেবলই সংসারের আয়-উন্নতির মধ্যে সীমাবদ্ধ, দেশ-জাতি নিয়ে, উম্মাহ নিয়ে যাদের কোনো ভাবনা নেই; মৃত্যুর মধ্য দিয়েই সচরাচর তারা মুছে যায় ইতিহাসের পৃষ্ঠা থেকে। পৃথিবী তাদের গভীর শ্রদ্ধায় আর ভালোবাসায় স্মরণ করে না। উত্তর-প্রজন্মও কৌতূহল বোধ করে না তাদের জীবনী থেকে শিক্ষা গ্রহণের। ইঞ্জিনিয়ার হিশাম আল তালিব তাঁর বিখ্যাত বই ‘A Training Guide For Islamic Workers’- এ তাদেরকে ‘মিস্টার এভারেজম্যান’ হিসেবে সম্বোধন করেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘শতকরা পঁচাশি শতাংশ মানুষ হলো এই শ্রেণিভুক্ত।’ এর বিপরীতে মাত্র পনেরো শতাংশ মানুষ হন বিপ্লবী। তাঁরা ইতিহাস বিনির্মাণে অংশগ্রহণ করেন। শহীদ আবু সাঈদ তেমনই এক বিপ্লবী নাম।

চব্বিশের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের অন্যতম নায়ক আবু সাঈদ। রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ১২তম ব্যাচের মেধাবী শিক্ষার্থী। এক মুহূর্ত আগেও যে ছেলেটিকে চিনতো না পৃথিবী, মৃত্যুর মধ্য দিয়ে তিনিই হয়ে উঠলেন বাংলাদেশের ১৮ কোটি মজলুম মুক্তিকামী জনতার মুক্তি আর বিজয়ের বার্তাবাহক। চব্বিশের এই বিপ্লবী মিছিলে যে চব্বিশ বছর বয়সী তরুণ পুলিশের গুলির মুখে দাঁড়িয়েছিলেন বুক টানটান করে, কে জানত— তাঁর শাহাদাতই বাজিয়ে দেবে প্রবল পরাক্রমশালী স্বৈরশাসকের বিদায় ঘণ্টা। দেশজুড়ে ছড়িয়ে দেবে বিপ্লব আর দ্রোহের আগুন। ধনী ঘরের আদুরে দুলাল ফারহান ফাইয়াজ আর মুগ্ধরাও নেমে আসবে রাজপথে, অকাতরে বিলিয়ে দেবে প্রাণ। নাহিদ ইসলাম আর আসিফ মাহমুদরা আন্দোলনের ফসল ঘরে তুলতে হয়ে উঠবেন আরও বদ্ধপরিকর।

২.

জুলাইয়ের ১৬ তারিখ দুপুরবেলা। কবি আল মাহমুদের কবিতার ভাষা থেকে ধার করে বললে বলতে হয়— ‘জুলাইয়ের ষোলো তারিখ দুপুর বেলার অক্ত/ বৃষ্টি নামে, বৃষ্টি কোথায়? আবু সাঈদের রক্ত/ হাজার যুগের সূর্যতাপে জ্বলবে এমন লাল যে/ সেই লোহিতেই লাল হয়েছে কৃষ্ণচূড়ার ডাল যে!’ কৃষ্ণচূড়ার ডাল লাল করবার প্রত্যয় নিয়েই সম্ভবত একজন তরুণ দুই হাত প্রসারিত করে বুক টানটান হয়ে দাঁড়ালেন পুলিশের গুলির সামনে। জায়গাটা হাজারো ঐতিহ্যের প্রাচীন শহর রংপুর। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মুখভাগ। একদিকে স্বৈরাচারের লেলিয়ে দেওয়া পুলিশ, অন্যদিকে দেশকে মুক্ত করবার ব্রত নিয়ে দাঁড়ানো দেশপ্রেমিক ছাত্র-জনতা।

রংপুরের বিপ্লবী নূরলদীন যেন ফিরে এলেন আরেক বিপ্লবী আবু সাঈদের মধ্য দিয়ে। দুই হাজার চব্বিশ যেন হয়ে উঠল বাংলা ১১৮৯ সন। কবি সৈয়দ হকের উচ্চারণের মতো শোনো গেল কোনো গগনজোঁয়ারী উচ্চারণ— ‘জাগো, বাহে, কোনঠে সবায়?’ এ কী আবু সাঈদেরই কণ্ঠধ্বনি? কে হাঁকে এই লহুতে আগুন লাগানো তপ্ত স্লোগান? কিছুক্ষণ বাদেই গোটা দুনিয়া অবাক বিস্ময়ে টেলিভিশনের পর্দায় দেখল সেই দৃশ্যটি। যে তরুণ রাষ্ট্রের দিকে পেতে দিয়েছে বুক, পড়তে অনুরোধ করেছে তাঁর অভিমানের ভাষা, সে তরুণ জানে না— তাঁর অভিমান পড়বার যোগ্যতা এই রাষ্ট্রের নেই। এই রাষ্ট্র মূর্খ, অযোগ্য, অপদার্থ। গুলিই তাঁর উত্তর দেবার একমাত্র যোগ্যতা।

রংপুরের রাজপথে লুটিয়ে পড়ল আবু সাঈদের দেহ। স্বৈরশাসক জানতে পারল না— এই নিরপরাধ তরুণের লুটিয়ে পড়ার সাথে সাথেই লুটিয়ে পড়েছে তার ক্ষমতার মসনদও। এই ঘটনার পর চূড়ান্ত পতনের জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে আর মাত্র ২০ দিন। বাংলাদেশের মানুষ অসীম বিস্ময় নিয়ে লক্ষ্য করেছে শিক্ষার্থীদের অমিত শক্তি আর সাহস। যাদের পতনকে অনেকেই ভেবেছিল অকল্পনীয়, কী অবিশ্বাস্য দ্রুততায় ভেঙে খানখান হয়ে গেছে তাদের গদি! ৫ আগস্ট আওয়ামী স্বৈরশাসনের পতনের মধ্য দিয়ে যবনিকাপাত ঘটেছে দীর্ঘ ১৬ বছরের অন্ধকার অধ্যায়ের। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে দেশের কোটি কোটি মুক্তিপ্রত্যাশী জনতা। শহীদ আবু সাঈদের বুক পরিণত হয়েছে বাংলাদেশের হৃদয়ে।

৩.

জুলাইয়ের ৩১ তারিখে গিয়েছিলাম শহীদ আবু সাঈদের পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে। রংপুর জেলার পীরগঞ্জ উপজেলার জাফরপাড়া গ্রামে নিজ বাড়ির পাশেই এই মহান বিপ্লবী তরুণের কবর। গোটা দেশের মানুষকে মুক্তির স্বাদ পাইয়ে দিয়ে তিনি ঘুমিয়ে আছেন নিশ্চিন্তে নিরালায়। যেন সংগ্রামী মিছিলের নেতৃত্ব দিতে গিয়ে বড্ড ক্লান্ত তিনি! যেন আজ তাঁর বিশ্রামের বড়ো প্রয়োজন! তাঁর কববের পাশে দাঁড়িয়ে প্রাণখুলে দোয়া করলাম। একটু ঈর্ষাও কি হলো না আমার? প্রায় আমার কাছাকাছি বয়সী এক তরুণ কী ভীষণ দ্রোহের স্ফূলিঙ্গই না ছড়িয়ে গেলেন! শুনিয়ে গেলেন— ‘উদয়ের পথে শুনি কার বাণী, ভয় নাই ওরে ভয় নাই/ নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান, ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই!’

দেখা হলো শহীদের গর্বিত মায়ের সঙ্গে। রংপুরের অতি সহজ-সরল গ্রাম্য নারী৷ এই মা কি জানেন— কত মহান বিপ্লবী সন্তানকে গর্ভে ধারণ করেছিলেন তিনি! যাঁর শাহাদাত অতি সাধারণ দাবির একটি আন্দোলনকে পৌঁছে দিয়েছে অকল্পনীয় উচ্চতায়। ভেঙে দিয়েছে জালিমের মসনদ। কবর রচনা করেছে ষোলো বছরের স্বৈরশাসনের। আরও হাজারো তরুণকে উদ্দীপিত করেছে জীবন দিতে। বাংলাদেশের মানুষের বুক থেকে সরিয়ে দিয়েছে বিশাল এক জগদ্দল পাথর। মুক্তি পেয়েছে আয়নাঘরের মজলুম মানুষগুলো। মুক্তি পেয়েছে হাজারো নিরপরাধ রাজনৈতিক বন্দি। বিদায়বেলায় দেখা হলো শহীদের বড়ো ভাই আবু হোসেনের সঙ্গে। তাঁর চোখ থেকে ঠিকরে পড়ছে প্রগাঢ় ভ্রাতৃস্নেহ।

যখন ফিরছিলাম, তখন আমার বুকে চলছিল আবেগের উথাল-পাতাল ঢেউয়ের আস্ফালন। অজান্তেই মুষ্টিবদ্ধ হয়ে আসছিল হাত। ভেতর থেকে কেউ যেন বলছিল— কেন হয়ে উঠতে পারছো না একজন আবু সাঈদ? কে আটকায় তোমাকে? কার হিম্মত আটকায় কোনো বিপ্লবী জিন্দাদিল মর্দে মুজাহিদকে? আমাদের নিশ্চিত বিশ্বাস— শহীদ আবু সাঈদরা যে দ্রোহের তপ্ত অনল জ্বালিয়ে গেলেন, তা কেবল দুই হাজার চব্বিশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। আজ থেকে শত বছর পরও তাঁদের নিয়ে গল্প লেখা হবে। দেশের সকল সংকটের বাঁকে বাঁকে শহীদ আবু সাঈদ, মুগ্ধ আর ফারহানরা এসে দাঁড়াবেন আমাদের আশেপাশে। মিছিলে-স্লোগানে উত্তপ্ত করে তুলবেন রাজপথ।

লেখক : কলামিস্ট।

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *