রাত বাজে ৯টা। যাত্রাবাড়ী থানা। শুক্রবার বলে অনেকে ছুটি নিয়ে বাসায় চলে গেছে। কেউ পরিবারের সাথে সময় কাটানোর জন্য, কেউ বা বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেওয়ার জন্য। আজকে থানায় সারাদিনে শুধু ২টি চুরির জন্য কম্পলেইন্ট এসেছে। অফিসে বসে আছে শুধু অফিসার আহমেদ ও তার কিছু কলিগরা। কিছুক্ষন পর তারাও চলে যাবে। সবাই যাওয়ার জন্য প্রস্তুত, ঠিক এমন সময় থানার ফোন টি বেজে উঠলো। সবাই একটু অবাক হলো, আহমেদ ভাবলো সারাদিনে কিছু হলো না এখন ফোন বাজছে কেনো। কাছে যেয়ে দেখলো ফোনটি এসেছে ৯৯৯ থেকে। কেউ মজা করে ফোন দিয়েছে এই ভেবে নিশ্যনকচ বোধ করে ফোনটি ধরে কথা বলা শুরু করলো অফিসার আহমেদ –
অফিসার : যাত্রাবাড়ী থানা থেকে অফিসার আহমেদ বলছি, কিভাবে সাহায্য করতে পারি।
ওইপাশ : বিক্রম্পুর প্লাজায় প্রাএ ৩০ জনের একটি অস্ত্রধারি গুন্ডার দল হামলা করে পুরো মার্কেট দখল নিয়েছে! তাৎক্ষনাৎ
সাহায্য দরকার!
অফিসার : আপনি কোনো চিন্তা করবেন না। আমরা এক্ষুনি সেখানে ২টি ইউনিট পাঠাচ্ছি।
ঢাকা শহরে এমন জঙি হামলা ৭ বছরের ডিউটি তে থাকা অবস্থায় আগে কখনো দেখেননি অফিসার আহমেদ। থানায় থাকা সবাই প্রস্তুত হয়ে ২টি ইউনিট রেডি করে ২টি গাড়ী তে করে যাত্রা শুরু করলো। আহমেদ ছিলো ১ম ইউনিট এ, গাড়ীর ভেতর পরিবেশ একটু অস্থির। সবাই একটু আতনকিত। কে কি করবে শুধু এই ভাবছে। আহমেদ সবাই কে প্রস্তুত হতে বললো, কারন সাম্নেই বিক্রম্পুর প্লাজা।সবাই বিক্রমপুর প্লাজার সামনে
নেমেই দেখতে পেলো সামনে ৪টি গাড়ী লাইন ধরে দারিয়ে আছে। আতংকবাদিদের গাড়ীই হবে ভাবলেন অফিসার আহমেদ। গাড়িগুলো থেকে কিছু দূরে জনগন দাড়িয়ে আছে। ২য় ইউনিট এর কয়েকজনকে গাড়ীগুলো চেক করতে বললেন। বাকিদেরকে নিয়ে আহমেদ ভিতরে ঢুকার জন্য হাটা শুরু করলেন। কিন্তু ঢুকার সময় অফিসার
আহমেদ লোকজনের দিকে তাকিয়ে খেয়াল করলেন লোকজনের চেহারায় যেরোকম আতঙ্ক থাকার কথা ও রকম আতঙ্ক নেই। তিনি মনে মনে ভাবলেন হয়তো
করোনায় এতদিন বাসায় থেকে তাদের আতংকবোধ চলে গিয়েছে। কিন্তু ভিতরে ঢুকে অফিসার, আহমেদ নিজেই অবাক হয়ে গেলেন। মার্কেটের ১ম প্লাজ তালায় অন্তত ১০ জন মুখোশ যুক্ত লোক পড়ে আছে মাটিতে। অফিসার আহম্মেদ ১ম ইউনিট এর ৩জন কে চেক করতে বললেন যে লোক গুলো জীবিত আছে নাকি মৃত এবং এই বলে ২য় তালার দিকে হাঁটা শুরু করলেন। কিন্তু ২য় তালায় এসে তিনি আবার অবাক হলেন। এইখানেও ১ম তালার মত অন্তত ১০ জল পরে আছে এবং কারো কারো গায়ে রক্তও লেগে আছে অফিসার আহম্মেদ শুধু অবাক হয়ে ভাবছেন এই কাজগুলো কে করতে পারে। অন্য কোনো ইউনিট কী তাদের আগে আসলে? না, সেটা তো সম্ভব না এত দ্রুত অন্য কোনো ইউনিট এর আসার কথা না? তাহলে কী ২টি জঙ্গি পক্ষে নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ হয়েছে? সেটাও দেখে মনে হচ্ছে না, সবার পরনে একই কাপড় এবং যুদ্ধ হলে আরোও ভাঙচুর হওয়ার কথা। আরেকটি জিনিস লক্ষ্য করলো আহমেদ, ১ম ও ২য় তালায় সব দোকান খালা থাকলেও ভেতরে কেউ নেই, তাহলে সবাই গেলো কোথায়?
আফসার আহমেদের মনে পড়লো মার্কেটের উপরে আরো তালা আছে সেখানে যাওয়া দরকার। ৩য় তালায় উঠতে অফিসার আহমেদ বোবা হয়ে গেলেন। তিনি দেখছেন সাধারন লোকজন ৩টি জঙ্গিকে পিলারের সাথে বাধছেন এবং কমপক্ষে ১০জনের কাছে অস্ত্র আছে এবং ৭ জনের হাঁতে সাউন্ড গ্রেনেড। ৩জন জঙ্গিকে দেখে মনে হচ্ছে তারা এই জঙ্গিদের নেতা। আশেপাশে আরো জঙ্গিদের দেহ পরে আছে। কয়েকটি জনগনের হাতে পায়ে রক্ত দেখেই বুঝা যাচ্ছে আহত। হঠাৎ ভিরের মাঝে আহমেদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা যাতাবাড়ী থানার ওসি শাহিন সাহেব এর দেখা পেলেন।
ওসি : আহমেদ, তুমি এখানে?
আহমেদঃ স্যার ৯৯৯ থেকে ফোন এসেছিলো এখানে জঙ্গি হামলা হচ্ছে কিন্তু এসে দেখছি সবই ঠিক আছে। আপনার তো আজকে অফ ডে ছিলো স্যার।
ওসিঃ হুম আজকে আমার অফ ডে ছিলো।আমি এখানে বাসার ফ্যান কিনতে এসেছিলাম।
আহমেদঃ এখানে কি হয়েছে স্যার একটু বলতে পারবেন?
ওসিঃ আচ্ছা আমি বলছি। হঠাৎ জঙ্গি রা এসে মার্কেট দখল করে সবাইকে ২ ও ৩ তালায় নিয়ে যায়। আমাকে ২য় তালায় নিয়ে আসা হয়। এমন সময় হঠাৎ নিচে থেকে গোলাগুলির শোরগোল শুরু হলে অনেকের মনযোেগ সরে যায় আমাদের উপর থেকে এবং সবাই নিচে যাওয়ার জন্য সিড়ির দিকে হাটা শুরু করে ঠিক এমন সময় আমি আমার পিস্তল দিয়ে ৩ জনকে ফায়ার করি। অন্যরা কিছু করার আগে জানালা দিয়ে এ একটি গোল কালো ক্যাপ এবং সাদা ওভারকোট পরা একজন এসে একটি স্মোক বম্ব ছেড়ে গোলাগুলি শুরু করে, আমি প্রথমে সাইলেন্সার বাতাসের আওয়াজ শুন্তে পেয়ে বুঝে গিয়েছি সে লুকিয়ে ফায়ার করছে এবং ধুয়া সরে গেলে দেখি সব জঙ্গি শুয়ে আছে। পরে নিচতলাথেকে আরো ২জন ওই লোকের মতো একই পোশাকে আসে। তারা সবল ১৫ জন লোককে অস্ত্র দিয়ে আমাকে নেতৃত্ব দিতে বলে ৩য় তালায় অপারেশন চালানোর জন্য এবং বলে কিছু হলে তারা সাহায্য করবে, এই বলে তারা চলে যায় আর আমি ৩য় তালায় অপারেশন চালানোর জন্য উপরে উঠা শুরু করলাম। ওখানে বেশিরভাগই জঙ্গি আতঙ্কে ছিলো এবং শুধু মেইন গেটে পাহাড়া দিয়েছিলো। কিন্তু মার্কেট এ ৩য় তালায় উঠার একটি ২য় গেট ছিলো যেখানে কারো মনোযোগ ছিলো না। আমরা সবাই ওই দিক দিয়ে
লুকিয়ে উঠি এবং দেখি ৩জন জঙ্গিকে তারা অতিরিক্ত সুরক্ষা দিয়ে রেখেছে। তাদের আমরা নেতা ধরে নিয়ে আমার সাথে বাকি যারা ছিলো তাদের থেকে ৫জন কে বলি ৩জন নেতার দিকে হামলা করে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে যাতে আমরা বাকিদের উপর হামলা চালাতে পারি। ফলে তারা তাদের মতো ওইদিকে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে ফলে কিছুলোক আহত হয় এবং তাদের মনোযোগ ওইদিকে চলে যায় আর আমরা বাকিদের কে আক্রমন করে সফলতা অর্জন করি।
ঘটনার বিবৃতি শুনে আহমেদ এর মনে হাজারো প্রশ্ন জাগলো
কিন্তু সে জানে এগুলোর উত্তর সে এখন পাবে না। অটিককৃত জঙ্গিদেরকে কারাগারে নেওয়ার জন্য এক্সট্রা ইউনিট ডাকলো অফিসার আহমেদ। এবং যারা আহত হয়েছিলো তাদের সুস্থতার জন্য একটি এম্বুলেন্সও ডাকলো সে।
কিছুক্ষন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষন করে একটু শান্ত হলো আহমেদ। মার্কেট এর বারান্দার সাইড এ এসে দাড়ালো সে। পকেট থেকে লাইটার টা বের করে সিগারেট ধরালো আহমেদ। স্ট্রেস বেড়ে গেলে আহমেদ সিগারেট ধরায়। সিগারেট টা মুখে নিয়ে আজকের শীতের রাতটা একটু উপভোগ করছে সে। চারিদিকে চেয়ে দেখছে আজকের রাস্তার কুয়াশা । ঠিক এইসময় দেখতে পেলো একটি রহস্যময় ব্যক্তি তার দিকে তাকিয়ে আছে। আহমেদ এর মনে কেমন জানি একটা ধাক্কা আসলো লোকটার পিছে যাওয়ার জন্য। সে মার্কট থেকে নিচে নেমে লোকটাত দিকে হাটা শুরু করলো । তাকে দেখেই রহস্যমই লোকটি হাঁটা শুরু করলো। অফিসার আহমেদ এর কেনো যেনো মনে হলো তার সকল প্রশ্নের উত্তর এই ব্যক্তি দিতে পারবে। সে মার্কেট থেকে বের হয়ে লোকটি যেদিকে গেলো সেদিকে হাঁটা শুরু করলো আহমেদ। লোকটি রাস্তার শেষ মাথায় গিয়ে ডানে মোড় নিলো। আহমেদ তার পিছু নিয়ে ডানে মোড় নিলো। দেখতে পেলো লোকটি আবার রাস্তার শেষ সিমানায় চলে গিয়ে বামে মোড় নিলো। অফিসার আহমেদ আবার তার পিছু নিলো এবং ভাবলো- লোকটি এত তাড়াতাড়ি কিভাবে রাস্তার শেষ সিমানায় চলে যাচ্ছে? রাতের অন্ধকার ও শীতের কুয়াশায় লোকটির আকৃতিও ভালোভাবে বুঝা যাচ্ছে না। এভাবে কিছুক্ষন হাটার পর লোকটিকে হঠাৎ হারিয়ে ফেললো আহম্মেদ।
তাকে খুজার জন্য আহমেদ কিছুক্ষন দৌড়ানো শুরু করলো।
দৌড়াতে দৌড়াতে আহমেদ একটি নিরব রাস্তায় প্রবেশ করলো। ঢাকা শহরে এই সময় এত নিরব কোনো রাস্তা কখোনো দেখেনি আহমেদ। গলিতে থাকা অ্যাপার্টমেন্টগুলো এক একটি ১০-১২ তালার। হঠাৎ লোকটিকে একটি এপার্টমেন্ট এ ঢুকতে দেখলো আহমেদ। পিছু নিয়ে অ্যাপার্টমেন্টটি তে প্রবেশ করলো আহমেদ। এসে দেখলো লোকাটি সিড়ি দিয়ে উপড়ে উঠছে। লোকটিকে ২, ৩ বার ডাক দেওয়ার পরেও লোকটি শুনলো না।
অ্যাপার্টমেন্টটির নিচ তলা টি অন্যান্য অ্যাপার্টমেন্ট এর সাপেক্ষে তুলনামুলক শান্ত। শুধু ৩টি গাড়ি পার্ক করা আছে এই বিশাল অ্যাপার্টমেন্টটির নিচ তালায়। আশেপাশে চেয়ে দেখলো কোনো দারওয়ান ও নেই অ্যাপার্টমেন্টটিতে। আহমেদ তার পিছু সিড়ি দিয়ে বাইতে শুরু করলো। উঠতে উঠতে সে ছাদে চলে গেলো। সেখানে দেখতে পেলো ছাদের মাঝখানে দাড়িয়ে আছে লোকটি আহমেদ এর দিকে মুখ করে। লোকটির একটু কাছে এসে লোকটির অবয়ব স্পষ্ট দেখতে পেলো আহমেদ। লোকটির পরনে একটি সাদা ওভারকোট। মোথায় গোল সাদা হ্যাট। মুখে একটি কালো স্কার্ফ। অন্ধকারে চোখ বুঝা যাচ্ছে না। দেখতে ঠিক ওসির বর্ণনার মতো। তার একটু পিছনে একই পোশাকে আরো দু’জন, ডানপাশের লোক্টির ওভারকোট কালো এবং বামপাশের লোকটির ওভারকোট ছাই রঙের। আহমেদ্ লোকটির থেকে অল্প দূরত্ব বজিয়ে রেখে কথা বলা শুরু করলো।
আহমেদঃ তোমরা কারা? আর আমাকে এখানে আনলে কেনো?
লোকটিঃ আমরা তোমাকে এখানে আনে আনি নি, তুমি নিজেই এসেছ। আর আমরা কারা এটা পরে বলবো।
আহমেদঃ তোমাদের উদ্দেশ্য কী? এই হামলা কী তোমরা চালিয়েছো?
লোকটিঃ আমাদের উদ্দেশ্য বোঝার সময় তোমার এখনো হয় নি। আর তোমার মনে হয় এই হামলা আমরা চালিয়েছি?
আহমেদঃ তাহলে তোমরা এত তাড়াতাড়ি কীভাবে আসলে?
লোকটিঃ আমরা তোমাদের মত একটি ৯৯৯ ফোন কলের জন্য বসে থাকি না। তারা ১ সপ্তাহ আগে থেকেই এ হামলার প্ল্যানিং করছিলো।
আহমেদঃ এতকিছু তোমরা কীভাবে জানলে?
লোকটিঃ দুঃখিত অফিসার আহমেদ; আমাদের সময় শেষ হয়ে গিয়েছে।আপনার কাছ থেকে আমরা আরো ভালো প্রশ্ন আশা করেছিলাম। কিন্তু এখন আমাদের যেতে হবে।
আহমেদঃ চলে যাওয়ার আগে তোমাদের নামগুলো বলে যাও।
লোকটিঃ আমাদের দলের নাম হচ্ছে আল আস’ওয়াদ এবং আপনি আমাকে আল আসাদ বলে সম্বোধন করতে পারেন। আল্লাহ হাফেজ।
কথা শেষ হতে না হতেই আল আসাদের ডান পাশে থাকা কাল ওভারকোট পরা লোকটি তার পকেট থেকে একটি গ্র্যাপলিন গান বের করে পাশের অ্যাপার্টমেন্টের সাথে দড়িটি ঠিক করল।
কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথে তিনজনই দড়িটি ধরে নিচে নেমে গেল। আহমেদ দৌরিয়ে তাদের পিছনে যেয়ে দেখতে পেলেন একটি লিমোজিন এ করে তারা চলে যাচ্ছে এবং দেখতে পেল আল আসাদ একটি হাত বের করে তাকে বিদায় দিচ্ছে।
সেখান থেকে এক পা পিছুতেই দেখল তার পায়ের নিচে একটি কাগজ পড়ে আছে, কাগজটি উঠিয়ে সেখানে লেখা আছে –
“Shall we meet again Officer Ahmed”। কাগজটি পকেটে রেখে চিন্তায় ডুবে গেল এবং আশ্চর্যিত হল আহমেদ। তারা নাকি তার থেকে আরো ভালো প্রশ্ন আসা করছিলো। আহমেদ কে কি তাহলে তারা আগের থেকেই চিনে? তারা নাকি ১ সপ্তাহ আগে থেকে হামলার কথা জানে। তাদের উদ্দেশ্যটা আসলে কী? এরা কে বা কারা? এদের এতো শক্তিশালী তথ্যের উৎস কোথা থেকে পেলো যেখানে পুলিশের ডিবি (ডিটেক্টিভ ব্রাঞ্চ) ও এ খবর পেলোনা। সব থেকে বেশি আশ্চর্যিত হলো আহমেদ এ কথা ভেবে যে সে যতক্ষণ তাদের সাথে কথা বলছিল তখন তাদেরকে আহমেদ নিজের শত্রু মনে করছিল না। কেন যেন আহমেদের মনে হচ্ছিল আল আসাদ তার আপন কেউ।
কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই অ্যাপার্টমেন্টের নিচে চলে গেল। কিছুক্ষণ পরেই তার স্ত্রী আফরোজার ফোন আসলো ফোনটি পিকআপ করে তার স্ত্রীর সাথে কথা বলা শুরু করল।
আফরোজাঃ তুমি কোথায় আছো? তোমার আসতে এত দেরি হচ্ছে কেন?
আহমেদঃ হঠাৎ একটি ইমারজেন্সি হয়েছে তাই আমাকে ফিল্ড এ আসতে হয়েছে। আমার আস্তে আস্তে একটু দেরি হবে।
আফরোজাঃ কেন কি হয়েছে? হঠাৎ তোমার এতো রাতে ফিল্ড এ আসতে হলো কেন কোন সমস্যা হয়েছে নাকি? আমাকে বুঝিয়ে বল সব। তুমি ঠিক আছো তো?
আহমেদঃ না না! আমার কিছু হয়নি, তুমি আমাকে নিয়ে চিন্তা করো না শুধু অল্প একটু কাজ বাকি আছে। তোমরা রাতের খাবার খেয়ে নাও আমি বাইরে থেকে খেয়ে আসব।
আফরোজাঃ ঠিক আছে তুমি সাবধানে এসো। আল্লাহ হাফেজ।
আহমেদঃ আল্লাহ হাফেজ।
কলটি রেখে আহমেদ ঘটনাস্থলের দিকে হাঁটা শুরু করল। সেখানে যেয়ে দেখল ওসি শাহীন সাহেব এর সামনে অনেকগুলো প্রেস মিডিয়া তার কাছ থেকে সাক্ষাৎকার নিচ্ছে।
সামনে গেল এবং শোনার চেষ্টা করার প্রেস মিডিয়া তার কাছ থেকে কেমন প্রশ্ন করছে। এমন সময় ওসি শাহীন সাহেব আহমেদকে দেখে ফেললেন এবং আসতে বললেন। আহমেদ প্রেসার সামনে এসে দাঁড়ালো। ওসি সাহেব প্রেস কে বললেন থানা থেকে অফিসার আহমেদ দুইটা ইউনিট নিয়ে এসেছিল কিন্তু এখানে এসে দেখেছে সব ঠিক আছে এবং আহতদের জন্য অ্যাম্বুলেন্স এর ব্যবস্থা আহমেদ ই করে দিয়েছিল।
প্রেস আহমেদ এর কাছ থেকে সাক্ষাৎকার নেওয়া শুরু করলো –
প্রেসঃ অফিসার আহমেদ আপনি কিভাবে জানতে পারলেন এখানে একটি জঙ্গি হামলা হয়েছে এবং কোন সময় আপনারা এখানে ইউনিট নিয়ে আসলেন?
আহমেদঃ রাত নয়টা বাজে যাত্রাবাড়ী থানায় ত্রিপল নাইন থেকে একটি ফোন আসে সেই ফোনে আমাদের জানানো হয় যে বিক্রমপুর প্লাজায় একটি জঙ্গি হামলা চলছে আমরা তাৎক্ষণাৎ দুইটি ইউনিট তৈরি করে ৯ টা সাতের ভেতর বিক্রমপুর প্লাজার সামনে এসে করি এবং ভেতরে সবাই চলে যাই কিন্তু ভেতরে দেখে যে দেখি যে সব জঙ্গিরা আগের থেকেই আহত এবং কয়েকজন নিহত হয়ে পড়ে আছে তারপর সাধারণ জনগণ যারা আহত হয়েছিল তাদের সুস্থতার জন্য অ্যাম্বুলেন্স ডাকাই।
প্রেসঃ আপনার কি মনে হয় এই হামলা চালিয়েছিল?
আহমেদঃ এ জঙ্গি দলকে বা কারা এখনো তদন্ত চলছে এবং জানতে পেরেছি হামলার পরিকল্পনা তারা একসপ্তাহ আগে থেকেই করেছিল।
প্রেসঃ ওসি শাহীন সাহেব থেকে আমরা শুনতে পেলাম তাদেরকে নাকি মুখোশবন্দী লোক সাহায্য করেছিল। আপনার কি মনে হয় এ লোকগুলো কারা হতে পারে?
আহমেদঃ আমি আশেপাশে তদন্তের মাধ্যমে জানতে পারলাম এ লোকগুলোর দলের নাম আল আসওয়াদ। এই দলটির নেতার নাম আল আসাদ। আমার সন্দেহ করছি নামটি এক ধরনের ছদ্মনাম।
প্রেসঃ আপনি এতক্ষন কোথায় ছিলেন আপনাকে আমরা এতক্ষণ আশেপাশে দেখলাম না কেন?
আহমেদঃ আমি কোন জায়গায় যাইনি আমি এখানে থেকেই তদন্ত চালাচ্ছিলাম শুধুমাত্র আপনাদের চেচা-মিচির জন্য দেখতে আসলাম এখানে কি হচ্ছে। দুঃখিত আমার সময় শেষ হয়ে গিয়েছে আমাকে এখন আবার ঘটনাস্থলে ফিরে যেতে হবে।
এই বলে প্রেস থেকে বিদায় নিয়ে অফিসার আহমেদ ঘটনাস্থলে যেয়ে বাকি তদন্ত শেষ করে থানায় যেয়ে তার ঊর্ধ্বতন কর্তাকে রিপোর্ট দিলো। রিপোর্ট শেষে অফিসার আহমেদের ফিরতে ফিরতে রাত দুইটা বেজে গেল। রাতের সারারাত আহমেদ তার এবং আল আসাদ এর সাথে করা কথোপকথন নিয়ে ভাবতে থাকলো।
শুকনো কাপড়গুলো ভাজ করে রেখে,ভেজাগুলো বারান্দায় নেড়ে দিলো রাহেলা।এখন কয়টা রুটি বেলে রাখলেই এখানকার কাজ শেষ।
রাহেলা কিছুক্ষণ পরপরই বারান্দায় উঁকি দিয়ে আবার রুমে চলে আসছে।
শেষবার এমন করার সময় মুনা বারান্দা থেকে রাহেলাকে ডেকে বলল,
রাহেলা কি কিছু বলতে চাচ্ছো?
রাহেলা চমকে উঠলো, সেই দুপুর থেকে মুনাকে ঝিম মেরে বারান্দায় বসে থাকতে দেখছে, কাছে যেতে রাহেলার আসলে একটু ভয়ই লাগছিলো
মুনা তাকে কখনো বকা টকা দেয় না তবুও মুনাকে রাহেলা একটু ভয়ই পায়।
আপা ব্যাতার ওষুদ আছে? শইল ব্যাতার?
হুম, ড্রয়ারে দেখো।মারামারি করেছো আবার?
কি যে কন আপা, আমি কি মারিনি হেয়ই তো একলা মারে, এইডারে কি মারামারি কয়নি!
কাজ করে খাও, এতো সহ্য করো ক্যান তাহলে?
আমাগো গরিবরার অনেককিছু সহ্য করতে হয় গো আপা!
মুনা মনে মনে বলল, কে কতটা মুখবুজে সহ্য করতে পারে সে পরীক্ষা অন্তত দরিদ্রদের মাঝে নেই।
মুনা মুখে কোন কথা বলল না, রাহেলাকে পুরো মাসের বেতনের সাথে আরো বেশ কিছু টাকা দিয়ে দিল।রাহেলা খুশি হবার বদলে অবাকই হল বেশি।
রাহেলা প্রশ্ন করার আগেই মুনা জানাল যে, কিছুদিন বাবার বাড়িতে গিয়ে থাকবে সে।
রাহেলা এ পরিবারের কাউকেই ঠিকঠাক বোঝে না।
মুনা ও আসিফের একমাত্র মেয়ে পৃথ্বী। পৃথ্বীকে আজ মায়ের কাছে রেখে এসেছে সকালে।
আজ রাতে আসিফের সাথে সরাসরি কিছু কথা বলবে মুনা।পৃথুটা বড় হচ্ছে, এবার ক্লাস ফোরে পড়ে।
আসিফ সবদিক এত চমৎকার করে সামলায় যে কেউ তার ত্রুটি পায় না। মেয়েও বাবাকে খুবই পছন্দ করে।মুনা যখন আসিফের সাথে রাগ করে কথা না বলে তখন পৃথুটাই বেশি কষ্ট পায়।পৃথু ভাবে তার বাবা কষ্ট পাচ্ছে। সেদিন মুনাকে সরাসরি বলল, বাবা যেমন কষ্ট পায় আমিও কষ্ট পাই তুমি চুপ করে থাকলে।
মুনা বলল, পৃথু তুমি ভয়ঙ্কর কষ্ট পাবে এমন একটা কাজ আমাকে খুব শীঘ্রই করতে হবে।এছাড়া অন্য কোন উপায় নেই।
এত কঠিন কথাগুলো ছোট্ট মেয়েটাকে এখন না বললেও হতো।
মুনা তার মাকে সেদিন আসিফের বিষয় খুলে বলেছে।মা সব শুনে পান চিবুতে চিবুতে বলল এক দরবেশের কথা, যেখানে গেলে বিপথগামী স্বামীদের সহজেই সংসারী করা যায়।মায়ের কথায় মুনা হতভম্ব হয়ে গেলো।
মুনাকে আরো অবাক করে দিয়ে মা আসিফের জন্য হাঁসের মাংস রান্না করে দিয়ে দিলো রাতে। তার কোন রাগ ক্ষোভ কিছুই দেখা গেলো না আসিফের প্রতি।
আসিফও রাতে হাঁসের মাংস খেতে বসে ফোনে মুনার মায়ের সাথে টানা মিনেট দশেক কথা বলল। শেষদিকে মুনা শুনলো যে আসিফ মাকে কোন এক টিভি প্রোগ্রামের কথা জানাচ্ছে ‘রন্ধনশিল্প ২০১৮’ নামে।
সেখানে মাকে অংশগ্রহন করতেই হবে।আর প্রথম সুযোগেই এই আইটেমটা রাঁধতে হবে তাহলেই নাকি মা টপ টেনে থাকবে।
মুনা বড় আপাকেও কিছু জানায়নি।গত একটা মাস ধরে মুনা শুধু ভেবেছে এমন পরিস্থিতির পরপর ঠিক কি ধরণের সমস্যায় ওকে পরতে হতে পারে।
বন্ধু বান্ধব আত্মীয় স্বজন যারা জানেন ওদের এতো বছরের প্রেমের পরের সুখের সংসার চলছে তাদের রিয়েকশন কেমন হবে।
ঠিক কতদিন এটা আলোচনায় থাকবে। পৃথুর স্কুল, বন্ধুদের কথা ভাবতেই সবচেয়ে ভয় লাগে।
মুনার খুব অসহায় লাগছে।
যেদিন প্রথম আসিফ আর সাবার কথা টুকটাক শুনেছিল,একটুও গায়ে মাখেনি।
ফোনে বাড়াবাড়ি রকমের বেশি কথা বলা,তা-ও কিছু মনে করেনি।
শেষমেষ তিনদিনের ট্যুরে যখন সাবাকে সঙ্গী হিসেবে আসিফের সঙ্গে দেখা গেল তখনি মুনা নতুন করে সব ভাবতে শুরু করতে হল।তা-ও তিন মাস হয়ে গেল।
আসিফকে প্রথম ও শেষবারের মতো একদিনই সরাসরি সাবার কথা জিজ্ঞেস করেছিল মুনা, তখন আসিফ চা খাচ্ছিল, তার চোখের পলকও পড়েনি বা চায়ে চুমুক দিতে এক মুহূর্ত দেরিও হয়নি। এত্ত স্বাভাবিক ছিল সে। শুধুই বন্ধুত্বের কথা জানিয়েছিল আসিফ সেদিন।আর জানিয়েছিল পাছে লোকে উল্টা পাল্টা বললে কানে না নিতে।
আজ আসিফকে কি কি বলবে তা বারবার গুছিয়ে নিচ্ছিল মুনা।কিন্তু মুনার মনে হচ্ছে শেষমেষ মুনার কিছুই বলা হবে না।
না কি একটা চিঠি লিখে চলে যাবে! মুখে মুখে তর্কটর্কের কোন ব্যাপার নেই। সিদ্ধান্ত তো নেয়াই আছে। শুধু জানিয়ে দেয়া।
রাহেলা আজ কি সুন্দর বলে গেলো, ওদের কত কি সহ্য করতে হয়! রাহেলাদের চোখে মুনারা ভিষন সুখী মানুষ। মুনাকে কখনো রাহেলার মতো পেইন কিলার খেতে হয়নি কিন্তু তিনমাস ধরে নিয়মিত রাতে মুনাকে ‘ইনডেভার’ খেতে হচ্ছে।
মুনা বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো।সন্ধা হচ্ছে।বারান্দার একটা টবেরর মরিচ গাছটার পাশেই পুঁইশাকের কয়েকটি ডাটা লাগিয়ে রেখেছিল।কি সুন্দর কচি কচি পাতা গজিয়েছে।আসিফ গতকাল এটা দেখে বলল, পুইশাক ডাটা দিয়ে চমৎকার একটা রান্না করা যায় জানো, এর জন্য লাগবে সামান্য কয়েকটা কাঁঠালের বিচি, ছোট নতুন লাল আলু আর ছোট মাছ।এই শুক্রবারেই তোমাকে এটা দেখিয়ে দিবো তুমি করে ফেলতে পারবে।
তুচ্ছ একটা ঘটনা, হয়তো আসিফ ঠিক ভুলে গেছে কিন্তু মুনার চোখে জল চলে এসেছে এসব ভাবতে ভাবতে।
কেউ কিছু খেতে চাইলে মুনার বাবা তাকে সেটা খাওয়াবেই।একবার এক চৈত্রের দুপুরে বাবা রিক্সা করে বাড়ি ফিরেছে। আসতে আসতে রিক্সাওয়ালা নাকি বলেছিলো তার লেবুর শরবত খেতে ইচ্ছে করছে।বাবা তাকে ঘরে ডেকে এনে বসিয়ে মুনার মাকে বলল লেবুর শরবত বানিয়ে দিতে।কিন্তু ঘরে কোন লেবু ছিল না সেদিন।তারপর মুনাকে পাশের বাড়ি থেকে লেবু চেয়ে আনতে হয়েছিল।
বাবার মতো আসিফেরও এমন অভ্যাস রয়েছে।একবার আসিফও.. .
মুনা চমকে উঠে খেয়াল করলো সে এই সময়ে আসিফকে নিয়ে এসব ভাবছে কেন! সে কি আসিফকে ছেড়ে যেতে পুরোপুরি তৈরি হয়নি এখনো!
মুনার চোখ জ্বালা করছে। মুনা পৃথুর রুমে গেল।সন্ধা সাতটা বেজে দশ।পৃথুর টেবিলে ফটো ফ্রেমে তাদের তিনজনের চমৎকার এক হাস্যোজ্জ্বল ছবি। আসিফের হাসি সবসময়ই প্রাণখোলা। পৃথুর মাথায় ঝাঁকড়া চুল।পৃথুর বয়স তখন কেবল দু বছর।
এ ছবি দেখেও মুনার চোখ জলে ভরে যাচ্ছে।আসিফ আসার আগে চোখের জল শুকাতে হবে।
কোনমতেই মুনা আজ কাঁদবে না। কেঁদে ফেলাটা হবে বিড়াট লজ্জ্বার অপমানের।
আসিফ আসে রাত আটটায়।এখনো মিনিট দশেক বাকি।
মুনা অপেক্ষা করছে।
Leave a Reply